RSS

বাবা কখনো এভাবে বলেনি

সময়টা ছিল অক্টোবর ২০০৯ সালের ৭ তারিখ, প্রতিদিনের মতো সকালে বাড়িতে ফোন করে মায়ের সাথে কথা বলল ।
মা - বলল খোকা তুর বাবা বাড়ি আসতে বলে ।
খোকা - না মা এখনো সম্ভব না, কোন প্রস্তুতি নেই বাড়ি যাওয়ার ।

বাবা মায়ের কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে নিল কেড়ে ।

বাবা - খোকা তুই বাড়ি আসবি না ।
খোকা - না, বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নেই ।
বাবা - না, বাড়ি চলে আয় ।
খোকা - এত তাড়া-তাড়ির কি আছে ? আগামী বছর যাব ।
বাবা - না, এ মাসেই চলে আয় । যত তাড়ি-তাড়ি সম্ভব।

খোকার মনটা নরম হয়ে গেল বাবার কথা শুনে, কেন বাবা এমন করে বলতেছে ? বিগত ২ বছর ৬ মাসে কখনো এরকম বলেনি । কিছুক্ষন চুপ থেকে চিন্তা করল ।

খোকা - ঠিক আছে এ মাস শেষ হোক বেতন নিই, তারপর ম্যানেজারকে বলে দেখব ।

বাবা- না, বেতন দিলে না দিলে ও চলে আসবি ।

বাবার কথা শুনে ছেলেটা মন বিগড়ে গেল । কেন বাবা এমন করে বলতেছে ।

ফোনে রেখে সাথে সাথে ম্যানেজারের সাথে কথা হল বাড়ি যাওয়া নিয়ে । বাড়ি যেতে কোন বাঁধা নেই, টিকেটের জন্য বুকিং দিল ২৭ অক্টোবর ২০০৯ ।
সাদা মাটা প্রস্তুতি নিয়ে বাড়ি যাওয়ার জন্য রেড়ি । প্রতিক্ষার প্রহর কবে আসবে ২৭ তারিখ । কাজে তেমন মন বসছে না ।

২৮ তারিখ রাত ১২.০০টায় চট্টগ্রাম বিমান বন্দরে অবতরণ । সেখানে অপেক্ষা করছে একটা বিষ্ময় । সকল বন্ধুরা বরণ করতে ফুল হাতে দাড়িয়ে রইল । অবাক ! তাড়া হুড় করে তাদেরকে বলিনি যে বাড়ি আসছি । সবাইকে এক সাথে পেয়ে অনেক ভাল লাগল । বাড়ির দিকে রওনা হলাম । পথে যে যার স্থানে বিদায় নিচ্ছে ।

ঘরে যাওয়ার আগে রাস্তা মা দাড়িয়ে রইল । আমাকে জড়িয়ে ধরতে অশ্রু চলে আসল মা'র । কখনো মা-বাবা কে ছেড়ে এতদিন কোথাও ছিল না । মাকে সাথে নিয়ে ঘরে গেল। বাবা খাটের উপর শোয়া, তেমন হাঁটা চলা করতে পারত না । কারণ মাত্র ৬ মাস আগেই ব্রেইন স্টোক করছিল । ছেলেকে দেখেই বসে পড়ল । বাবাকে দেখে কেমন জানি লাগল । কি রকম হয়ে গেছে । শরীরের চামড়া জড়া জড়া হয়ে গেছে । ক্ষীণ হয়ে গেল । বিদেশ পাড়ি দেয়ার আগে অনেক সুস্থ ছিল । বাম হাত বাড়িয়ে দেখাল "কোন শক্তি নেই এই হাতে এবং পায়ে ও" সাথে সাথে কয়েকটা আদেশ দিল যা মেনে চলার জন্য । তখন রাত প্রায় ২টা ।

পরদিন সকালে মা বিয়ের কথা উঠাতেই আমি ছাপ জানিয়ে দিলাম - যা টাকা পয়সা আছে এক মাসের বেশি চলবে না । একমাত্র তোমাদের কারণে চলে আসলাম । মা কে বুঝাতে পারলাম, বাবাকে বুঝানো গেল না ।

বাবার মনে গেঁথে আছে সেই মেয়েটি, যে ছোট বোনের সাথে বেড়াতে এসেছে সে ঈদে । মেয়েটি কে দেখার পর থেকে বাবা বাড়ি যাওয়া জন্য বলতেছে । মায়ের ও অপছন্দ ছিল না । এখন ছেলের মতামতের অপেক্ষা । পরের শুক্রবারে দেখার জন্য তাদের বাড়ি যাচ্ছে । না যাওয়ার সকল চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে বাধ্য হয়ে যেতে হল । বাবা রেগে গেল তাই, মা আর বোনেরা বলতেছে রাগের বসে আবার স্টোক হলে কে দায়ী । সন্ধ্যার দিকে দেখতে রওনা, বাড়ি থেকে মাত্র এক কিলমিটার দূরত্ব । দেখার পর প্রস্থাব ফিরিয়ে দেয়ার মতো কোন ইস্যু পাওয়া গেল না ।

এদিকে দুবাই থেকে দুলাভাই শালার বিয়ে খাওয়ার জন্য প্রস্তুত । বন্ধুদের সহযোগিতায় বিয়ের কাজ সেরে উঠল ডিসেম্বর ৬, ২০০৯ ।
নভেম্বরের ভিতরে বাবা বিয়ের জন্য তাড়াহুড় করল অনেক । দেরি হওয়াতে বাবা একটু নারাজ ছিল ।

২০ ডিসেম্বর বিয়ের পর প্রথম বেড়াতে যাব বলে রাতে পরিকল্পনা হচ্ছে । সেই সন্ধ্যায় ও সব ঠিক টাক ছিল, মা শীতপিঠা (ভাপা পিঠা) বানোর জন্য চালের গুডা তৈরি করছে । বাবাকে খাওয়া দেয়া হল বারান্দায় । হঠাৎ বাবা না খেয়ে বসে আছে । কি হল বাবা ? কোন খারাপ লাগছে ? নরম আওয়াজে বলল একটু খারাপ লাগছে, বক্ষে ব্যাথা অনুভব করছে । বলতে না বলতে শুয়ে পড়ল । তাড়া-তাড়ি ডাক্তারকে ফোন করলাম । ২/১ টা ঔষুধের নাম বলল দৌড়ে গিয়ে ফার্মেসি থেকে নিয়ে খাওয়ালাম । ২০/৩০ মিনিটে ভাল হয়ে গেল । বাবা ঘুমিয়ে পড়ল । ঘরের সবাই যার যার জায়গায় শুয়ে পড়ল । ঠিক এক ঘন্টা পর বাবার আবার সেই ব্যাথা, তাড়া তাড়ি উঠে দেখলাম সবার চোখে ঘুম লেগে আসল । মা কে ডেকে দিলাম, বাবা কেমন করছে । ডাক্তারকে ফোন করলাম, মেডিকেল নিয়ে যেতে পরামর্শ দিল । কিন্তু বাবা যেতে চাচ্ছেনা ।

সকাল পর্যন্ত বসে রইলাম । বাবা শুধু চট পট করছে । সকালে সব পরিকল্পনা লন্ড বন্ড হয়ে গেল । ডাঃ একবার এসে দেখে গেল, আধা ঘন্টা পর আবার আসবে বলে গেল, আধা ঘন্টা আর লাগেনি । তার আগেই সবচিত্র পাল্ঠে গেল । হঠাৎ কাল বৈশাখী ঝড় আমার মাথার ছাঁদ উড়িয়ে নিয়ে গেল । আমাদের রেখে চলে গেল না ফেরার দেশে । এই চিত্র মনে পড়লে এখনো আমাকে কাদাঁয় । ঘরে নতুন বউ আসাতে বাবা কত না খুশি হল । সে বউ তাকে একটু সেবা করার সময়টুকু দিল না । কেমন করে হতে পারে এটা । তাহার কি আগেই জানা ছিল এভাবে চলে যাবে ? না হলে কেন ছেলেকে বিদেশ থেকে আসতে বলল ? কেনই বা বিয়ের জন্য তাড়া হুড়ো করল ?

৬ ডিসেম্বর যে ঘরে ছিল আনন্দের জোয়ার ১৫ দিনের ব্যবধানে ২১ ডিসেম্বর হয়ে গেল নিস্তব্ধ । যা কল্পনাকেও হার মানায় ।

এটা আমার জীবনের ঘটে যাওয়া বাস্তব কাহিনী ।